শরীরে রক্ত কম হলে কি রোগ হয় ।
রক্ত মানুষের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। রক্ত শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে দেয় এবং বর্জ্য পদার্থ সরিয়ে নেয়। কিন্তু যখন শরীরে রক্ত কমে যায়, তখন একে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia) বলা হয়। রক্তের পরিমাণ কমে গেলে নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং কখনো কখনো তা মারাত্মক রোগের কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব—শরীরে রক্ত কমে গেলে কী কী রোগ হতে পারে, এর লক্ষণ, কারণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে।
রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া কী?
রক্তশূন্যতা তখনই ঘটে, যখন শরীরে রক্তে থাকা লোহিত রক্তকণিকার (RBC) সংখ্যা অথবা হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে একটি প্রোটিন, যা অক্সিজেন বহন করে। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না, ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
রক্ত কমে গেলে যে রোগগুলো হতে পারে:
রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia)
এটি সরাসরি রক্ত কমে যাওয়ার ফল। অ্যানিমিয়া নিজেই একটি রোগ এবং এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে:
- আয়রন ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া: আয়রনের অভাবে রক্ত তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না।
- ফোলেট ও ভিটামিন B12 ঘাটতিজনিত অ্যানিমিয়া: এই ভিটামিনগুলোর অভাবে রক্তের কোষ তৈরি কমে যায়।
- অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া: বোন ম্যারো রক্ত তৈরি বন্ধ করে দেয়।
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া: রক্তের কোষ সময়ের আগেই ভেঙে যায়।
হৃদরোগ
রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে হৃদপিণ্ড বেশি কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দনের সমস্যা এবং হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
ব্রেইন ডিজঅর্ডার
মস্তিষ্ক পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেলে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় মাথা ঝিমঝিম, বিভ্রান্তি এমনকি স্ট্রোকও হতে পারে।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যাওয়া
রক্তের লোহিত ও শ্বেত কণিকার ভারসাম্য নষ্ট হলে শরীর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে পারে না। ফলে বারবার অসুস্থ হওয়া, ইনফেকশন, সর্দি-কাশি লেগেই থাকে।
কিডনি সমস্যা
কিডনি ইরিথ্রোপয়েটিন (Erythropoietin) নামক হরমোন তৈরি করে, যা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেলে রক্তও কমে যেতে পারে, আবার রক্ত কমে গেলে কিডনির উপর চাপ পড়ে।
মাসিক সংক্রান্ত সমস্যা (নারীদের ক্ষেত্রে)
অতিরিক্ত রক্তশূন্যতা মেয়েদের মধ্যে মাসিক অনিয়মিত, বেশি রক্তপাত এবং পিরিয়ডের সময় দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গর্ভকালীন জটিলতা
গর্ভবতী নারীদের মধ্যে রক্ত কম থাকলে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে, শিশুর জন্মের সময় জটিলতা দেখা দেয়, শিশুর ওজন কম হয় বা প্রি-ম্যাচিওর ডেলিভারি হতে পারে।
রক্ত কমে যাওয়ার কারণগুলো
পুষ্টির অভাব:
- আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন B12 এবং প্রোটিনের অভাবে রক্ত তৈরি হয় না।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ:
- দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, মাসিক বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের কারণে রক্ত কমে যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি রোগ:
- ক্যানসার, কিডনি রোগ, থাইরয়েড সমস্যা, যক্ষা, হেপাটাইটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগ রক্ত তৈরির প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
- কিছু ওষুধ, যেমন কেমোথেরাপি বা অ্যান্টিবায়োটিক, রক্তকণিকা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।
জেনেটিক বা বংশগত রোগ:
থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো বংশগত রোগের কারণে রক্ত উৎপাদনে সমস্যা হয়।
লক্ষণসমূহ
- সর্বদা ক্লান্ত বোধ করা
- সহজেই শ্বাসকষ্ট হওয়া
- ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া
- মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথা
- হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
- মনোযোগ কমে যাওয়া
- চুল পড়ে যাওয়া
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
- আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: কলিজা, পালংশাক, ডিম, মটরশুঁটি, কলা, খেজুর, বিটরুট।
- ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12 সমৃদ্ধ খাবার: ব্রোকলি, ডাল, কমলা, ডিম, মাছ, দুধ।
- ভিটামিন C: আয়রন শোষণে সহায়ক। যেমন: লেবু, আমলকি, মাল্টা।
আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ
- রক্তশূন্যতা বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে আয়রন বা ফোলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট গ্রহণ করতে হবে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি থাকলে বিশ্রাম নিন।
- রক্তের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সময়মতো রক্ত পরীক্ষা করান।
যাদের মাসিক বেশি হয় বা দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে, তারা নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
নিম্নলিখিত উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন:
- ক্রমাগত দুর্বলতা
- অস্বাভাবিকভাবে ফ্যাকাশে চেহারা
- বুক ধড়ফড় করা
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
- হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
- বাচ্চাদের বৃদ্ধি থেমে যাওয়া বা খাওয়ায় অনীহা
রক্তবর্ধক খাদ্যতালিকা (দিনভিত্তিক)
- সকাল ৮টা – নাস্তা
- ১টি সিদ্ধ ডিম
- ১ গ্লাস দুধ বা সয়া দুধ
- ১টি কলা বা পাকা পেঁপে
- ২ টুকরো পাউরুটি বা রুটি (পিনাট বাটার বা কলিজা দিয়ে)
সকাল ১১টা – হালকা নাস্তা
- ১ গ্লাস ফ্রেশ মাল্টা/কমলার রস
- ২টি খেজুর বা ৫টি কিশমিশ
দুপুর ১টা – মধ্যাহ্নভোজ
- ১ কাপ ভাত/চাল রুটি
- ১ কাপ ডাল বা মসুর ডাল
- ১ বাটি পালং শাক/কলমি শাক
- ১ টুকরো গরুর কলিজা (ভুনা করা)
- ১ টুকরো লেবু
বিকাল ৪টা – হালকা খাবার
- বিটরুট-গাজর-আপেল স্মুদি
- ১টি সিদ্ধ ডিম বা বাদাম
রাত ৮টা – রাতের খাবার
- ২টি রুটি বা ১ কাপ ভাত
- ১ বাটি সবজি (কুমড়া, মিষ্টি আলু, গাজর)
- ১ টুকরো মাছ/মুরগি
- ছোট বাটি টকদই
- আমলকি/লেবু
রক্তবর্ধক রেসিপির তালিকা
কলিজা ভুনা (গরু/খাসি)
উপকরণ:
- কলিজা টুকরো ২০০ গ্রাম
- পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, হালকা মসলা
- সামান্য লেবুর রস
পদ্ধতি:
- সব মসলা দিয়ে ভুনা করে খেতে পারেন রুটি/ভাতের সঙ্গে।
বিটরুট-গাজর স্মুদি
উপকরণ:
- ১/২ কাপ বিটরুট কুচি
- ১/২ কাপ গাজর কুচি
- ১টি আপেল
- ১ গ্লাস পানি
- ১ চা চামচ মধু
পদ্ধতি:
- সব উপকরণ ব্লেন্ড করে সকালে বা বিকেলে পান করুন।
শাক-পালং ডিম ভাজি
উপকরণ:
- পালং শাক ১ কাপ
- ১টি ডিম
- পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, হালকা তেল
পদ্ধতি:
- শাক ভেজে ডিম দিয়ে মিশিয়ে নরম করে ভুনা করে পরিবেশন করুন।
খেজুর-বাদাম বল
উপকরণ:
- খেজুর ১০টি
- কাঠবাদাম ও কাজুবাদাম
- সামান্য তিল
- পদ্ধতি:
- সব উপকরণ একসাথে ব্লেন্ড করে ছোট বল তৈরি করুন। দিনে ১–২টি খান।
আমলকি-লেবুর পানীয় (ভিটামিন C)
উপকরণ:
- ১টি আমলকি
- ১/২টি লেবুর রস
- ১ গ্লাস পানি
- সামান্য লবণ ও মধু
পদ্ধতি:
সব মিশিয়ে পান করলে আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
এই খাদ্যতালিকা ও রেসিপিগুলো নিয়মিত মেনে চললে শরীরে আয়রন ও অন্যান্য রক্ত তৈরির উপাদানের ঘাটতি পূরণ হবে। বিশেষ করে যাদের রক্তশূন্যতা রয়েছে, গর্ভবতী নারী, কিশোর-কিশোরী, অথবা অপারেশন/রক্তপাতের পর সুস্থ হতে চাচ্ছেন—তাদের জন্য এই তালিকা অত্যন্ত কার্যকর।
আমাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url