হিমোগ্লোবিন কম হলে কি কি সমস্যা হয়?

মানবদেহে হিমোগ্লোবিন এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি রক্তের লোহিত কণিকায় (RBC) থাকে এবং এর প্রধান কাজ হচ্ছে দেহের কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া এবং শরীর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দেওয়া। 

হিমোগ্লোবিন কম হলে কি কি সমস্যা হয়? শরীরে রক্ত কম হলে কি রোগ হয় হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয় হিমোগ্লোবিন কম হলে কি খাওয়া উচিত হিমোগ্লোবিন কম হওয়ার লক্ষণ শরীরে রক্ত কম হলে কি কি সমস্যা হয় রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ কি হিমোগ্লোবিন কম হলে কি খাওয়া উচিত নয় রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধির ঔষধ

যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, তখন আমাদের শরীর নানা ধরনের জটিলতার সম্মুখীন হয়।

এই পোস্টে আমরা জানব:

হিমোগ্লোবিন কী?

হিমোগ্লোবিন একটি প্রোটিন জাতীয় পদার্থ, যা আয়রন দিয়ে গঠিত এবং রক্তের লোহিত কণিকার মধ্যে থাকে। এটি দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে এবং দেহের কাজ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  1. পুরুষদের জন্য স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন মাত্রা:
  • ১৩.৮–১৭.২ গ্রাম/ডেসিলিটার
  1. নারীদের জন্য:
  • ১২.১–১৫.১ গ্রাম/ডেসিলিটার
  1. শিশুদের জন্য:
  • ১১–১৬ গ্রাম/ডেসিলিটার

হিমোগ্লোবিন কমে গেলে যে সমস্যাগুলো হয়

হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াকে সাধারণভাবে রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া) বলা হয়। এর প্রভাব সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে।

অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা

হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। ফলে ক্লান্তি, নিস্তেজ ভাব এবং প্রতিদিনের ছোটখাটো কাজেও দুর্বলতা অনুভব হয়।

মাথা ঘোরা ও মনোযোগে ঘাটতি

অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে ঘন ঘন মাথা ঘোরা, ঝিমুনি ও একাগ্রতা হারানোর মতো সমস্যা দেখা দেয়।

শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া

হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন বহনের কাজ করে। এটি কমে গেলে ফুসফুস থেকে নেওয়া অক্সিজেন সঠিকভাবে শরীরের কোষে পৌঁছায় না।

হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে

হিমোগ্লোবিন কমে গেলে হৃদযন্ত্র শরীরের চাহিদা পূরণে দ্রুত কাজ করতে থাকে, যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়।

শ্বাসকষ্ট

সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, হাঁটা বা হালকা কাজ করলেও হিমোগ্লোবিন কম থাকলে দ্রুত শ্বাস নিতে হয়।

ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া

শরীরে রক্তের লাল কণিকা ও হিমোগ্লোবিন কমে গেলে ত্বক ও চোখের পাতার নিচের অংশ ফ্যাকাশে দেখায়।

হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া

রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হওয়ায় শরীরের প্রান্তবর্তী অংশে রক্ত কম পৌঁছায়, ফলে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

প্রজনন সমস্যাও দেখা দিতে পারে

নারীদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিন কম থাকলে মাসিক অনিয়ম, গর্ভধারণে সমস্যা এবং গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দেয়।

হিমোগ্লোবিন কমার কারণগুলো কী?

আয়রনের ঘাটতি

হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য সবচেয়ে দরকারি উপাদান হলো আয়রন। খাদ্যে পর্যাপ্ত আয়রন না থাকলে হিমোগ্লোবিন কমে যায়।

ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12-এর অভাব

এই দুটি উপাদানের অভাবেও হিমোগ্লোবিন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

  • দুর্ঘটনা বা অপারেশনের মাধ্যমে
  • বেশি ও অনিয়মিত মাসিক
  • অভ্যন্তরীণ রক্তপাত (আলসার, পাইলস)

বংশগত সমস্যা

থ্যালাসেমিয়া বা সিকল সেল অ্যানিমিয়া-র মতো জিনগত রোগেও হিমোগ্লোবিন কমে যায়।

দীর্ঘস্থায়ী রোগ

কিডনি সমস্যা, ক্যান্সার, যক্ষা, অথবা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ হিমোগ্লোবিন হ্রাসের কারণ হতে পারে।

হিমোগ্লোবিন কম থাকলে কী কী পরীক্ষা করা উচিত?

  • CBC (Complete Blood Count)
  • Serum Ferritin (আয়রনের মাত্রা নির্ধারণে)
  • Vitamin B12 Test
  • Folic Acid Level
  • Stool Test (রক্তক্ষরণ আছে কিনা)

হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় ও প্রতিকার

আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া

  • গরু বা খাসির কলিজা
  • পালং শাক, কলমি শাক, কচু শাক
  • গাজর, বিটরুট
  • ডাল, মটর, শিম
  • খেজুর, কিশমিশ, গুড়

ভিটামিন C যুক্ত খাবার

ভিটামিন C আয়রনের শোষণ বাড়ায়, যেমন:
  • আমলকি
  • লেবু
  • কমলা
  • পেয়ারা

প্রোটিন ও ভিটামিন B12

ডিম, দুধ, মাছ, চিজ, দই ইত্যাদি।

হিমোগ্লোবিন বাড়াতে প্রাকৃতিক রেসিপি

  • বিটরুট-আপেল জুস: প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন।
  • খেজুর ও দুধ: রোজ রাতে শোবার আগে খান।
  • তিল ও মধু: কালো তিল ভেজে গুড় বা মধুর সঙ্গে খান।

একটি উদাহরণস্বরূপ হিমোগ্লোবিন-বৃদ্ধিকারী খাদ্যতালিকা

সময় খাদ্য উপকারিতা

  • সকাল ৩টি খেজুর + ১ গ্লাস দুধ আয়রন ও শক্তি
  • সকালের নাস্তা ডিম, রুটি, ফল প্রোটিন, ভিটামিন
  • দুপুর ভাত, ডাল, কলিজা/মাছ, শাক আয়রন ও B12
  • বিকেল আপেল/পেয়ারা/কমলা ভিটামিন C
  • রাত রুটি, ডিম ভাজি, গাজর ফোলেট ও আয়রন
  • হিমোগ্লোবিন কমে গেলে করণীয় জীবনধারা পরিবর্তন
  • খাবারে ভিটামিন ও খনিজযুক্ত উপাদান রাখুন
  • বেশি চা-কফি পরিহার করুন (আয়রনের শোষণ কমায়)
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
  • নিয়মিত হাঁটাচলা ও হালকা ব্যায়াম করুন
  • পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করুন

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন

  • শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা বা অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হলে
  • মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত
  • গর্ভাবস্থায় দুর্বলতা ও ফ্যাকাশে ভাব
  • হিমোগ্লোবিন বারবার কমে যাচ্ছে
  • চিকিৎসক প্রয়োজনে আয়রন ট্যাবলেট, ইনজেকশন বা রক্ত সঞ্চালন দিতে পারেন।

হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শুধু শরীর দুর্বল হয় না, বরং মস্তিষ্ক থেকে হৃদযন্ত্র—সবকিছুতে এর প্রভাব পড়ে। এটি এক নীরব ঘাতক। কিন্তু সচেতনতা, পুষ্টিকর খাদ্য ও সঠিক অভ্যাসে হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রণে রাখা একেবারেই সম্ভব। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতাই হতে পারে এর সেরা প্রতিরোধ।

আপনার রক্তই আপনার শক্তি—সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url