রক্তশূন্যতায় ভোগার লক্ষণ গুলো কি কি?
রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যখন রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দেয়। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, যা লোহিত রক্তকণিকায় থাকে এবং শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন পায় না, ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যেগুলোকে রক্তশূন্যতার লক্ষণ বলা হয়।
এই ব্লগে আমরা রক্তশূন্যতার লক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যাতে আপনি সহজেই বুঝতে পারেন কখন এই সমস্যাটি আপনার শরীরে দেখা দিচ্ছে এবং কীভাবে আপনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেন।
রক্তশূন্যতার সাধারণ লক্ষণসমূহ
অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
রক্তশূন্যতায় ভুগলে শরীর সবসময় ক্লান্ত এবং দুর্বল লাগে। আপনি যতই বিশ্রাম নেন না কেন, ক্লান্তিভাব কাটে না। হিমোগ্লোবিন কম থাকায় শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, ফলে কোষগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।
শ্বাসকষ্ট
হালকা পরিশ্রমেও অনেক সময় মনে হতে পারে আপনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। এটি হিমোগ্লোবিনের অভাবের কারণে রক্তে অক্সিজেন পরিবহণ ব্যাহত হওয়ার ফল।
হৃদস্পন্দনের তারতম্য (প্যালপিটেশন)
হৃদয় রক্তে অক্সিজেনের অভাব পূরণ করতে বেশি পরিশ্রম করে, যার ফলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় বা অনিয়মিত হয়। অনেক সময় বুক ধড়ফড়ানি বা ব্যথাও হতে পারে।
মাথা ঘোরা বা মাথা ঝিমঝিম করা
মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পৌঁছালে মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করার অনুভূতি হতে পারে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে এই সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে।
ত্বক ও ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
ত্বক এবং বিশেষ করে চোখের নিচের অংশ, নখ, ঠোঁট ফ্যাকাশে দেখালে সেটি রক্তশূন্যতার লক্ষণ হতে পারে। রক্তে লোহিত কণিকা কমে গেলে স্বাভাবিক লালাভ বর্ণ কমে যায়।
ঠান্ডা হাত ও পা
রক্ত চলাচলের ঘাটতির কারণে হাত ও পা ঠান্ডা অনুভব হতে পারে। এটি মূলত শরীরে রক্ত সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হলে দেখা দেয়।
মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা
অক্সিজেনের ঘাটতি মস্তিষ্কের কাজের উপর প্রভাব ফেলে। ফলে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয় এবং স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে।
ঘন ঘন অসুস্থ হওয়া বা সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া
রক্তশূন্যতা থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে আপনি সহজেই ঠান্ডা, জ্বর বা অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারেন।
নির্দিষ্ট কিছু রক্তশূন্যতার লক্ষণ
রক্তশূন্যতা বিভিন্ন কারণে হতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা (Iron Deficiency Anemia)
- মুখের কোণ ফাটা বা ব্যথা
- নখ ভঙ্গুর হওয়া বা চামচ আকৃতি ধারণ করা
- মুখে পিপড়া চলার মতো অনুভব
- অদ্ভুত কিছু খাওয়ার ইচ্ছে (যেমন: মাটি, বরফ, সাবান ইত্যাদি)
ভিটামিন B12 ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা
- হাত-পা ঝিনঝিন বা অবশ হয়ে যাওয়া
- হাঁটায় ভারসাম্যহীনতা
- মনমরা ভাব বা হতাশা
- স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা
অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (Aplastic Anemia)
- শরীরে অকারণে ক্ষত বা রক্তপাত হওয়া
- চামড়ার নিচে নীলচে দাগ
- ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া
শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে লক্ষণ
শিশুদের মধ্যে রক্তশূন্যতা অনেক সময় নিরব ঘাতকের মতো কাজ করে। তারা দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য, স্কুলে মনোযোগ কম দেওয়া, এবং স্বাভাবিক বিকাশে ব্যাঘাতের মতো লক্ষণ দেখাতে পারে।
নারীদের মধ্যে বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের রক্তশূন্যতা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, গর্ভাবস্থায় পুষ্টির ঘাটতি ইত্যাদি কারণে তারা এই সমস্যায় বেশি ভোগেন।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
রক্তশূন্যতার উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর মধ্যে একাধিক লক্ষণ যদি দীর্ঘদিন ধরে দেখা দেয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষা (CBC - Complete Blood Count) করালেই বোঝা যাবে আপনি রক্তশূন্যতায় ভুগছেন কিনা এবং সেটি কতটা গুরুতর।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
- আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন B12 সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে: যেমন পালং শাক, কলিজা, ডিম, ডাল, লাল মাংস, বিটরুট, কলা, খেজুর ইত্যাদি।
- গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খাওয়া উচিত।
- ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
- দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত রক্তপাত হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রক্তশূন্যতা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি অবহেলা করলে বড় বিপদের কারণ হতে পারে। শারীরিক ও মানসিক কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে জটিল শারীরিক অবস্থা পর্যন্ত গড়াতে পারে এই একটি সমস্যার কারণে। তাই রক্তশূন্যতার প্রাথমিক লক্ষণগুলো চেনা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সহজেই এই সমস্যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে পারি।সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন!
আমাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url