রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ কি?
রক্ত মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। এই রক্তের মাধ্যমেই অক্সিজেন ও পুষ্টি শরীরের প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায়। রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো হিমোগ্লোবিন (Hemoglobin)। এটি একটি প্রোটিন, যা লোহিত রক্তকণিকার (RBC) মধ্যে থাকে এবং অক্সিজেন পরিবহন করে।
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরে অক্সিজেনের যোগান ব্যাহত হয়, ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নানা রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়।
আজকের এই ব্লগে আমরা জানব:
- হিমোগ্লোবিন কী
- হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
- লক্ষণ ও ঝুঁকি
- কাদের বেশি হয়
- এবং কিভাবে তা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়
হিমোগ্লোবিন কী?
হিমোগ্লোবিন হলো এক ধরনের লৌহজাত প্রোটিন, যা রক্তকে লাল রঙ দেয় এবং ফুসফুস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়। একই সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কোষ থেকে সংগ্রহ করে ফুসফুসে ফেরত আনে।
🔹 পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন মাত্রা: ১৩.৮ – ১৭.২ গ্রাম/ডেসিলিটার
🔹 মহিলাদের ক্ষেত্রে: ১২.১ – ১৫.১ গ্রাম/ডেসিলিটার
🔹 শিশুদের ক্ষেত্রে: ১১ – ১৬ গ্রাম/ডেসিলিটার
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে গেলে তাকে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia) বলে।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার সাধারণ লক্ষণ
- সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া
- মাথা ঘোরা
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- নিঃশ্বাসে কষ্ট
- বুকে ধড়ফড় বা ব্যথা
- ঠোঁট ও নখের নিচে ফ্যাকাশে ভাব
- একাগ্রতা হ্রাস
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ
আয়রনের ঘাটতি
হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হলো আয়রন। যখন খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত আয়রন থাকে না বা শরীর সেটি শোষণ করতে পারে না, তখন হিমোগ্লোবিন কমে যায়।
কারণসমূহ:
- আয়রন-ঘাটতিজনিত খাদ্যাভ্যাস
- দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি
- অন্ত্রের সমস্যা (যেখানে আয়রন ঠিকমতো শোষিত হয় না)
ভিটামিন B12 ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব
ভিটামিন B12 এবং ফলিক অ্যাসিড হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এই উপাদানগুলোর অভাবে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন ব্যাহত হয়।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
বেশি রক্তপাত হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণ:
- অতিরিক্ত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব
- দুর্ঘটনা বা অস্ত্রোপচারে রক্তপাত
- পাইলস, আলসার বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাত
- প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ
অন্ত্রের রোগ
সেলিয়াক ডিজিজ বা ক্রনের রোগের মতো অন্ত্রের সমস্যায় শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন বা ভিটামিন শোষণ করতে পারে না।
সংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ
- যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন:
- যক্ষা (TB)
- কিডনি সমস্যা
- ক্যানসার
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
- এসব রোগ শরীরের রক্ত উৎপাদন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়।
জেনেটিক বা বংশগত কারণ
থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া ইত্যাদি বংশগত রোগ হিমোগ্লোবিন কমিয়ে দেয়।
দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ও অভ্যাসগত ত্রুটি
- চা বা কফি খাওয়া খাবারের সঙ্গে সঙ্গে (যা আয়রনের শোষণ বাধাগ্রস্ত করে)
- ডায়েটিং করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি বাদ দেওয়া
- বেশি ফাস্টফুড খাওয়ার অভ্যাস
কাদের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি?
- মহিলা: ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, সন্তান জন্মদান
- কিশোরী: দ্রুত বেড়ে ওঠার সময় বেশি পুষ্টির প্রয়োজন হয়
- গর্ভবতী নারী: শিশুর জন্য অতিরিক্ত রক্ত তৈরি করতে হয়
- বয়স্ক ব্যক্তি: হজমশক্তি কমে যায়
- শিশু: যদি জন্মের সময় কম ওজন বা অপুষ্ট হয়
- শাকাহারী: যদি খাদ্যতালিকায় ভিটামিন B12-এর ঘাটতি থাকে
হিমোগ্লোবিন কমে গেলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
- শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে শিশু কম ওজনে জন্মায়
- শিশুদের বুদ্ধি ও বিকাশে প্রভাব ফেলে
- হৃদরোগ বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হতে পারে
✅হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া প্রতিরোধে করণীয়
আয়রনসমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া
- লাল শাক, পালং শাক, কলিজা, ডাল, ছোলা, গুড়
- শুকনো ফল (কিশমিশ, খেজুর)
🍊 ভিটামিন C বেশি খান
- আমলকি, মাল্টা, কমলা, লেবু, পেয়ারা – এগুলো আয়রন শোষণে সহায়তা করে।
🥛 ভিটামিন B12 ও ফলিক অ্যাসিড
- ডিম, দুধ, মাছ, কলিজা, টক দই
- ফলিক অ্যাসিড: মুগ ডাল, কুমড়া, মিষ্টি আলু
🥜 প্রাকৃতিক ঘরোয়া উপায়
- প্রতিদিন ৩টি খেজুর + ১ চা চামচ মধু
- গাজর-বিট-আপেল স্মুদি
- তিল ও গুড়ের লাড্ডু
- আমলকির রস
🚶♂️নিয়মিত ব্যায়াম করুন
চলাফেরা ও শরীরচর্চা করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং শরীর নিজে থেকে হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে সাহায্য করে।
📌 চিকিৎসকের পরামর্শ কখন জরুরি?
- হিমোগ্লোবিন মাত্রা ৯ gm/dL এর নিচে
- দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, নিঃশ্বাসে কষ্ট
- গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন নিচে নেমে যাওয়া
- শিশুর বৃদ্ধি থেমে যাওয়া
- চিকিৎসক প্রয়োজন অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট, ইনজেকশন বা অন্যান্য চিকিৎসা দেন।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া কোনো তুচ্ছ সমস্যা নয়। এটি হলে শুধু শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে না, বরং শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি প্রতিরোধের জন্য সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া উপায়ে হিমোগ্লোবিন বাড়ানো সম্ভব, তবে দেরি না করে শরীরের সংকেতগুলো বুঝে সচেতন হোন।
শক্তির উৎস রক্ত—আর রক্তের প্রাণ হিমোগ্লোবিন। তাই রক্তের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন।
আমাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url